বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির পর দেশে-বিদেশে তদন্তে নেমেছে বিভিন্ন সংস্থা। এর অংশ হিসেবে গতকাল ব্যাংকের সব কর্মকর্তার ল্যাপটপ আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং অ্যাকাডেমি ও শাখা অফিসের সব কর্মকর্তার ল্যাপটপ সংশ্লিষ্ট অ্যাকাডেমি বা অফিসের আইটি সেলে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ল্যাপটপ জমা দেয়ার জন্য সময় দেয়া হয়েছে মাত্র দুই দিন। অর্থাৎ আগামীকাল বুধবারের মধ্যে ল্যাপটপ জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের হিউম্যান রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্ট-১ থেকে এ ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান তদন্তের স্বার্থে ব্যাংক সব কর্মকর্তার ল্যাপটপ সংগ্রহ করে সিকিউরিটি এজেন্ট ইনস্টল করে নেটওয়ার্ক চলমান করা প্রয়োজন। এ জন্য সব কর্মকর্তাকে ল্যাপটপ জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রত্যেক কর্মকর্তার ল্যাপটপ ফেরত দেয়া হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তার ল্যাপটপ রয়েছে। হঠাৎ ল্যাপটপ জমা দেয়ার নির্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা। তাদের মতে, তদন্তের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অক্ষম করা হচ্ছে। কর্মস্পৃহা নষ্ট করা হচ্ছে। এতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে শতভাগ ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। তদারকি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে কার্যত দেশের ৫৬টি ব্যাংক ও ৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিবিড় সংযোগ রয়েছে। প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন দাখিল করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। ওইসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সরবরাহকৃত তথ্য পর্যালোচনা করে থাকে। কোনো তথ্যে আর্থিক অসঙ্গতি দেখা দিলে, সে অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর তদারকি করা হয় এবং প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোকে জরিমানা করা হয়। আগে এসব কাজ করা হতো ম্যানুয়ালি অর্থাৎ ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক প্রতিবেদন কাগজের ফাইলে জমা দিত। গত ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে এটা অনলাইননির্ভর করা হয়। অর্থাৎ এখন আর কাগজে আর্থিক প্রতিবেদন ব্যাংকগুলো জমা দেয় না, জমা দেয়া হয় অনলাইনের মাধ্যমে।
এ ছাড়া ডিজিটালাইজেশনের আওতায় সরকারের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ও গ্রাহকের মূল টাকা অনলাইনের মাধ্যমে পরিশোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে গ্রাহককে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকে আসতে হতো। এখন ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে মুনাফা পাচ্ছেন সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকেরা। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহেই সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। আর এসব ঋণের নিলাম ডাকা হয় অনলাইনের মাধ্যমে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরো কার্যক্রমই এখন অনলাইনের আওতায় আনা হয়েছে। এসব কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রায় দেড় হাজার ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও তাদের কার্যক্রমে এখন ল্যাপটপনির্ভর হয়ে পড়েছেন।
এমনি পরিস্থিতিতে তদন্তের নামে ল্যাপটপ জমা দেয়ার নির্দেশনায় হতবাক হয়েছেন অনেক কর্মকর্তা। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস, ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশন (ডস), ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি বিভাগ, মনিটারি পলিসি বিভাগ, ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর কার্যক্রম পুরোপুরি কম্পিউটারনির্ভর হয়ে পড়েছে। এসব বিভাগের কর্মকর্তারা অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, কোনো এক সপ্তাহের কাজ পিছিয়ে গেলে পুরো মাসের কাজে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া দিনের কাজ দিনেই যেখানে অনেক সময় শেষ করা যায় না, অনেকেই বাসায় গিয়েও ল্যাপটপে অফিসের কাজ করেন এ অবস্থায় কম্পিউটার জমা দিলে কবে তদন্ত শেষ হবে, আর কবে তারা কম্পিউটার ফেরত পাবেন এ আশঙ্কায় ভুগছেন কর্মকর্তারা।
এ দিকে, এর আগে হঠাৎ করে সিকিউরিটির নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কম্পিউটার ও ল্যাপটপে ভারতের নাগরিক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত আইটি কনসালট্যান্ট রাকেশ আস্তানার মৌখিক পরামর্শে তারই সরবরাহকৃত সিকিউরিটি প্যাচ নামক একটি সফটওয়্যার ইনস্টল করার নির্দেশ দেয়া হয়। এতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অনেকেই প্রথমে তথ্য পাচার হওয়ার আশঙ্কায় এটা ইনস্টল করেননি। কিন্তু পরে বাধ্য হয়ে ইনস্টল করেছেন। এখন আবার ল্যাপটপ জমা দেয়ার নির্দেশনায় একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কর্মকর্তাদের মধ্যে।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি হওয়ার পর এমনিতে তদন্তের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাকে নাজেহাল করা হচ্ছে। এতে প্রায় সব বিভাগের কাজকর্মে স্থবিরতা নেমে এসেছে। অনেকেই শুধু হাজিরা দেয়ার জন্য অফিসে আসছেন। নতুন করে ল্যাপটপ জমা দেয়ার নির্দেশনায় অনেক কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। বিষয়টি নতুন গভর্নর ফজলে কবিরের দৃষ্টিগোচর করার জন্যও অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
wWw.FB.Com/mNews24