ঢাকা: তিন বলে দরকার দুই রান। সেখানে তিন বলে নেই তিন উইকেট। দুটি ক্যাচ, একটি রান আউট। শেষ বলে ব্যাট ছোয়াতেই পারলেন না শুভাগত। তাও দিলেন মরণপণ দৌড়। মুস্তাফিজও তাই। ঠাণ্ডা মাথার ধোনি দূর থেকে স্ট্যাম্প ভাঙতে পারতেন, কিন্তু তা না করে দৌড়ে এসে নিশ্চিত হয়েই গুড়িয়ে দিলেন স্ট্যাম্প।
এক রানের জয় পেল ভারত। ততক্ষণে বেঙ্গালুরুর এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম দর্শকদের গর্জনে ফেটে পড়ছে। ধোনিদের উল্লাস তখন বাধনহারা। দিকভ্রান্তের মতো ধোনি-কোহলি-হার্দিকরা দৌড়াচ্ছে জয়ের আনন্দে। যেন বিশ্বকাপই জেতা হয়ে গেছে তাদের।
আর বাংলাদেশ শিবিরে নিকষকালো হতাশার ছায়া। সবার মুখ মলিন। ‘এত কাছে তবু দূরে’র যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট সবাই। হাতের মুঠোয় আসা জয় ফসফে বেরিয়ে গেল চরম নির্বুদ্ধিতায়। মাত্র এক রানের হার। সঙ্গে বিশ্বকাপ থেকেও বিদায়।
অথচ ম্যাচটিতে জিততে পারলে চিত্রটা কি সুন্দরই না হতো। সেমির সম্ভাবনা জিইয়ে থাকত। শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারলে কে জানে সব সমীকরণ ঠেলে শেষ চারেও উঠে যেতে পারত মাশরাফিরা। কিন্তু হায়, ২৬ মার্চ কলকাতার ইডেন গার্ডেনে কিউইদের বিরুদ্ধে টাইগারদের নামতে হবে নিয়মরক্ষার ম্যাচ খেলতে। ভাগ্য বড়ই নির্মম ও কঠিন।
ওয়ানডেতে পারলেও টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের সামনে দুর্বোধ্যই ছিল ভারত। কিছুদিন আগে এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ও ফাইনালে হেরে তা বুজেছে বাংলাদেশ দল। কিন্তু বুধবার বেঙ্গালুরুতে টি২০ বিশ্বকাপের ম্যাচে ভাগ্য বিধাতা সবই দিচ্ছিল বাংলাদেশকে উজার করে। সুযোগটা নিতে পারেনি মাশরাফিরাই।
টানা টস হারে ক্লান্ত মাশরাফি এদিন টস জিতলেন। বেঙ্গালুরুর ব্যাটিং স্বর্গ উইকেটে বল হাতে আগুণ ঝড়ালেন মাশরাফি-আল আমিনরা। ফলে বিশ্বমানের ব্যাটিং লাইন আপ নিয়েও ভারত করতে পারল মাত্র ১৪৬ রান। মাশরাফিতো টি২০ বোলিং ক্যারিয়ারে নতুন রেকর্ড গড়লেন কোন চার-ছক্কা হজম না করে। ৪ ওভারে ২২ রান দিয়েছেন, তবে ভারতীয় কোন ব্যাটসম্যানই পারেননি তাকে সীমানা ছাড়া করতে। সাকিব ৪ ওভারে দিলেন মাত্র ২৩, উইকেট একটি, চার হজম করেছেন মাত্র দুটি। সব মিলিয়ে বোলিং বিভাগের নৈপুণ্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
অথচ বেঙ্গালুরুর ইতিহাস ছিল ভিন্ন। এই মাঠে আগে যারা ব্যাট করেছে, তাদের গড় স্কোর ১৮৯। ভারত সেখানে কষ্টেসৃষ্টে করল ১৪৬।
ভাগ্য বিধাতা বাংলাদেশের সঙ্গে ছিল পরের ইনিংসেও। না হলে দুইবার লাইফ কেন পাবে তামিম। কেন সহজ কয়েকটি ক্যাচ হাত গলে বেরিয়ে যাবে ভারতীয় বোলারদের হাত থেকে। তবে সেটা যে ছিল অতিরিক্ত চাপেই, তা বলাই বাহুল্য। ভাগ্যকে অবশ্য দুষতে পারেন সাব্বির। পপিং ক্রিজেই ছিলেন, তবে শূন্যে থাকা অবস্থায় হয়েছেন স্ট্যাম্পিং, ব্যাড লাক।
তারপরও সবার চোখ আটকে যাচ্ছে শেষ ওভারেই। মানতে কষ্ট হচ্ছে অভিজ্ঞ মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহর কাণ্ডজ্ঞানহীন শট। অথচ জয়ের নায়ক হতে পারতেন মুশফিকই। শেষ ওভারে দুই চার হাঁকিয়ে জয়টা নিয়ে এসেছিলেন হাতে মুঠোয়। চতুর্থ ও পঞ্চম, দুটো বলই ফুলটস দিলেন হার্দিক পান্ডে। লোভে পড়লেন দুই ভাইরা ভাই। বিদায় নিলেন পরপর দুই বলে। প্রতিপক্ষের হাতে ক্যাচ দিয়ে। শেষটা সুপার ওভারে গড়ালেও হয়তো আফসোস কম থাকত। কিন্তু পারেননি শুভাগত।
তাসকিন ও সানিকে হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে কেঁদেছিলেন মাশরাফি। অসিদের সঙ্গে হারলেও লড়াই করেছিল বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে জিততে পারলে সব কষ্ট উবে যেত, চলার পথে এই ম্যাচই হতো প্রেরণার। কিন্তু এখন গোপনে মাশরাফির চোখ বেয়েই যে অশ্রু ঝড়ছে না, তা বলবে কে। যদিও মাশরাফি ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘এই হারে কাউকে দায়ী করছি না। সবাই আক্ষেপে পুড়ছে।’
২০১২ সালে ঘরের মাঠে এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে দুই রানের হারে সাকিবের বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিল মুশফিক, সঙ্গে কেঁদেছিল গোটা দল, গোটা দেশ। বছর চারেক পর বেঙ্গালুরুতে তেমনই আবহ। তবে আফসোস-আহাজারির সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে ক্ষোভ। তিন বলে দুই রান না করতে পারলেন না মুশফিক ও রিয়াদ, উল্টো উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসলেন। অথচ সেখানে সিঙ্গেল খেললেও হতো। ভক্তদের ক্ষোভ-আহাজারি প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে, মুশফিক-রিয়াদ এই বেদনার যন্ত্রণায় কতদিন গুমড়ে গুমড়ে মরবে, তা কে জানে।
বাংলাদেশ হারলেও টি২০ ক্রিকেটে নতুন রেকর্ড হয়েছে এদিন। ম্যাচের শেষ তিন বলে আউট মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক ও মুস্তাফিজ।শেষ তিন বলে তিন উইকেট, টি২০ ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ঘটনা। টি২০ ক্রিকেটে এক রানে জয়-পরাজয়ের ঘটনা নবমবারের মতো ঘটল। টি২০ বিশ্বকাপে যা চতুর্থ ঘটনা। এর মধ্যে দুইবারই জিতল ভারত, আগেরবার ২০১২ সালে কলম্বোতে তারা ১ রানে হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো হারল ১ রানে। আগেরটি ছিল দুই রানের হার, সেটি ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। শ্রীলঙ্কা আগে ব্যাট করতে নেমে করেছিল ১৬৮ রান, জবাবে বাংলাদেশ করেছিল ১৬৬।
তবে শুধু টি২০ কেন, ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটেও এক রানের এমন অবিশ্বাস্য হারের নজির নাই বাংলাদেশের। আহা, এ কষ্ট কোথায় রাখি।